“ধাত্রী” শব্দটি বাংলা ভাষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ শব্দ, যার ব্যবহার প্রধানত প্রসবকালীন পরিচর্যা এবং সেবাদানকারী নারীদের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এটি মূলত একজন নারীর প্রতি নির্দেশ করে, যিনি গর্ভবতী মায়েদের প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী যত্ন গ্রহণ করেন। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির ব্যবহার ঐতিহাসিক এবং সামাজিকভাবে গভীরভাবে প্রোথিত।
“ধাত্রী” শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে, যেখানে “ধাত্র” (धात्र) শব্দের অর্থ “যিনি ধারণ করেন” বা “যিনি পালন করেন”। এটি “ধা” (धा) ধাতু থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো পালন করা, রক্ষা করা বা পরিচর্যা করা। ফলে “ধাত্রী” বলতে বোঝানো হয় এমন একজন নারীকে, যিনি প্রসূতি নারীর দেখভাল করেন এবং প্রসব প্রক্রিয়ায় সাহায্য করেন।
ধাত্রীর ভূমিকা ও দায়িত্ব :
প্রাচীনকাল থেকেই ধাত্রীর ভূমিকা সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ও হাসপাতাল ব্যবস্থা গড়ে ওঠার আগে ধাত্রীরা প্রসবকালে নারীদের প্রধান সহায়ক ছিলেন। এখনো অনেক গ্রামাঞ্চলে বা অনুন্নত এলাকায় ধাত্রীদের ভূমিকা অপরিহার্য। নিচে ধাত্রীদের মূল কাজগুলো আলোচনা করা হলো:
১. গর্ভবতী নারীর যত্ন নেওয়া:
ধাত্রীরা গর্ভবতী নারীর শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন। তারা গর্ভকালীন খাবার, বিশ্রাম এবং স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে পরামর্শ দেন, যাতে গর্ভকালীন জটিলতা কম হয়।
২. প্রসবকালীন সহায়তা প্রদান:
প্রসবের সময় ধাত্রী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা মায়ের পাশে থেকে তাকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সহযোগিতা করেন। প্রসব প্রক্রিয়া স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন করতে তারা বিশেষ কিছু কৌশল ও অভিজ্ঞতা প্রয়োগ করেন।
৩. নবজাতকের পরিচর্যা করা:
প্রসবের পর ধাত্রী নবজাতকের যত্ন নেন। নবজাতকের শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিকমতো হচ্ছে কি না, দেহের তাপমাত্রা স্বাভাবিক আছে কি না, এসব বিষয়ে বিশেষ নজর রাখেন। নবজাতকের গোসল, দুধ পান করানো ও শারীরিক যত্ন নেওয়ার কাজেও ধাত্রীরা সাহায্য করেন।
৪. মায়ের সুস্থতার দিকে নজর দেওয়া:
প্রসব-পরবর্তী সময়ে ধাত্রী মায়ের সুস্থতার দিকে খেয়াল রাখেন। রক্তপাত, সংক্রমণ বা অন্যান্য কোনো সমস্যা হলে তিনি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন এবং প্রয়োজনে ডাক্তার বা বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে বলেন।
প্রাচীন সমাজে ধাত্রীর গুরুত্ব :
প্রাচীনকালে যখন হাসপাতাল ও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না, তখন ধাত্রীদের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেই সময়ে নারীরা বাড়িতে সন্তান প্রসব করতেন এবং ধাত্রীরা ছিলেন একমাত্র অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যিনি পুরো প্রসব প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করতেন। সমাজে ধাত্রীদের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হতো, কারণ তারা শুধু প্রসব সহায়কই ছিলেন না, বরং সন্তান জন্মদানের সময় একজন মায়ের জীবন রক্ষার দায়িত্বও পালন করতেন।
এছাড়া রাজপরিবারেও বিশেষ ধাত্রী রাখা হতো, যাদের কাজ ছিল রাজপরিবারের নারীদের সন্তান জন্মদানের সময় সহযোগিতা করা। অনেক রাজা-মহারাজা ও নবাবদের দরবারে দক্ষ ধাত্রীদের বিশেষ সম্মান দেওয়া হতো এবং তাদের জন্য আলাদা বাসস্থান ও ভাতা নির্ধারিত থাকত।
আধুনিক সমাজে ধাত্রীর পরিবর্তিত ভূমিকা :
বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যা ও হাসপাতালের উন্নতির ফলে ধাত্রীদের ভূমিকা অনেকটাই কমে এসেছে। এখন শহরাঞ্চলে বেশিরভাগ নারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকে সন্তান প্রসব করেন, যেখানে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও নার্সরা থাকেন। তবে এখনো অনেক গ্রামাঞ্চলে ও প্রত্যন্ত এলাকায় ধাত্রীদের গুরুত্ব রয়ে গেছে।
বর্তমানে “মিডওয়াইফ” বা “প্রসূতি সেবিকা” শব্দটি আধুনিক ধাত্রীর সমার্থক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফদের মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের উন্নত সেবা দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে ধাত্রীদের কাজ এখন আরও আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে।
উপসংহার :
“ধাত্রী” শব্দটি শুধুমাত্র একজন প্রসব সহায়ক নারীর পরিচয় বহন করে না, এটি নারীর মাতৃত্ব, মানবসেবার মহান দায়িত্ব ও সামাজিক ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রাচীনকাল থেকে ধাত্রীগণ নারীদের প্রসবকালীন সেবা প্রদান করে আসছেন, যা সমাজে তাদের গুরুত্বকে অনস্বীকার্য করে তুলেছে।
যদিও আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের ভূমিকা অনেকাংশে কমিয়ে দিয়েছে, তবুও ধাত্রীদের ঐতিহাসিক ও সামাজিক অবদান কখনোই ভুলে যাওয়া যাবে না। বর্তমান যুগেও প্রশিক্ষিত মিডওয়াইফ ও ধাত্রীদের ভূমিকা অপরিহার্য, বিশেষ করে গ্রাম ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাই তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সম্মান প্রদান করা উচিত, যাতে তারা স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মায়েদের প্রসবকালীন সেবা দিতে পারেন।