ফিকহ (فقه) শব্দটি আরবি ভাষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শব্দ, যা ইসলামি শরীয়তের অন্তর্গত। এটি ধর্মীয় আইন, নৈতিকতা এবং দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত কার্যক্রমের নির্দেশনা প্রদান করে। “ফিকহ” শব্দটি আরবি “ফাকিহা” (فَقِهَ) ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ হলো “বোঝা”, “গভীরভাবে অনুধাবন করা” বা “জ্ঞান অর্জন করা”। এটি ইসলামি আইনের এমন একটি শাখা যা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিক নির্দেশনা দিতে সাহায্য করে।
ফিকহের সংজ্ঞা:
ফিকহ শব্দটি ইসলামে নিম্নলিখিত অর্থে ব্যবহৃত হয়:
1. শব্দগত অর্থ: ফিকহ শব্দটি আরবিতে “বোঝাপড়া” বা “গভীর জ্ঞান” বোঝায়। এটি সাধারণ জ্ঞানের চেয়ে গভীর এবং বিশেষ ধরনের জ্ঞান অর্জনের দিক নির্দেশ করে।
2. শরীয়তের পরিভাষা: ফিকহ ইসলামের সেই শাস্ত্র, যা কোরআন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে মুসলিমদের দৈনন্দিন জীবনের সব বিষয়ে আইনি দিকনির্দেশনা প্রদান করে। এটি হালাল (যা বৈধ) ও হারাম (যা অবৈধ) বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা দেয়।
ফিকহের উৎপত্তি ও বিকাশ:
ফিকহের বিকাশ ইসলামি সভ্যতার শুরু থেকেই। এটি মূলত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন ও সুন্নাহর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে, সাহাবারা কোরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর জীবন থেকে নির্দেশনা গ্রহণ করতেন। পরবর্তী সময়ে এটি আরো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে।
ফিকহের বিকাশের সময়কালকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়:
1. রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগ: এই সময়ে ফিকহের মূল ভিত্তি ছিল কোরআন এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী ও কাজ।
2. খোলাফায়ে রাশেদিনের যুগ: সাহাবারা তাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে ফিকহকে সমৃদ্ধ করেছেন।
3. ইমামগণের যুগ: এই সময়ে বিখ্যাত চার ইমাম (ইমাম আবু হানিফা, ইমাম মালিক, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল) ফিকহকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো প্রদান করেন।
ফিকহের মূল উপাদান:
ফিকহ প্রধানত চারটি প্রধান উৎসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে:
1. কোরআন: ইসলামের প্রধান ধর্মগ্রন্থ।
2. সুন্নাহ: রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বাণী, কাজ এবং অনুমোদন।
3. ইজমা: মুসলিম উম্মাহর ঐক্যমত্য।
4. কিয়াস: কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
ফিকহের শাখা:
ফিকহকে দুটি প্রধান শাখায় ভাগ করা যায়:
1. ইবাদাহ (উপাসনা সংক্রান্ত বিধি): নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদির বিধান।
2. মুয়ামালাত (পারস্পরিক সম্পর্ক সংক্রান্ত বিধি): বিয়ে, তালাক, ব্যবসা-বাণিজ্য, উত্তরাধিকার, অপরাধ বিচার ইত্যাদির বিধান।
ফিকহের গুরুত্ব:
ফিকহ মুসলিমদের জীবনের প্রতিটি দিক পরিচালিত করতে সাহায্য করে। এটি কেবল ধর্মীয় উপাসনা নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং নৈতিক বিষয়েও নির্দেশনা দেয়। ফিকহের কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো:
1. আইনি দিকনির্দেশনা: ফিকহ মুসলিমদের বৈধ ও অবৈধ কাজ সম্পর্কে সঠিক ধারণা প্রদান করে।
2. নৈতিকতা: এটি মুসলিমদের নৈতিক জীবনে সঠিক পথ অনুসরণ করতে সাহায্য করে।
3. সামাজিক ভারসাম্য: ফিকহ সমাজে শান্তি, ন্যায় এবং ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য নির্দেশনা দেয়।
ফিকহের বিভিন্ন মাজহাব:
ইসলামি ফিকহের বিভিন্ন মাজহাব (পদ্ধতি) রয়েছে, যা একই কোরআন ও সুন্নাহ থেকে প্রাপ্ত কিন্তু বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। প্রধান চারটি মাজহাব হলো:
1. হানাফি মাজহাব
2. মালিকি মাজহাব
3. শাফেয়ি মাজহাব
4. হাম্বলি মাজহাব
উপসংহার:
ফিকহ শব্দটি ইসলামি শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা, যা মানুষের জীবনের প্রতিটি বিষয়ে দিকনির্দেশনা দেয়। এটি মুসলিমদের জন্য একটি গাইডলাইন, যা তাদের ধর্মীয়, সামাজিক এবং নৈতিক জীবনে সাহায্য করে। ফিকহের মাধ্যমে একজন মুসলিম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলতে পারে। এটি শুধু একটি শাস্ত্র নয়, বরং মুসলিমদের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান।