গ্রাফিতি (Graffiti) শব্দটির অর্থ হলো প্রাচীর বা অন্যান্য পৃষ্ঠে আঁকা বা লেখা শিল্পকর্ম। এটি সাধারণত প্রকাশ্য স্থানে রং, কালি বা খোদাই করার মাধ্যমে তৈরি হয়। গ্রাফিতি শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ “graffito” থেকে, যার অর্থ “খোদাই করা”। মূলত, এটি ছিল প্রাচীনকালে গুহার দেয়ালে বা রোমান সভ্যতার সময়ে পাথরে খোদাই করা লেখা ও চিত্রের একটি অংশ। বর্তমানে এটি আধুনিক শিল্প ও সামাজিক মতামত প্রকাশের একটি মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
গ্রাফিতির ইতিহাস :
গ্রাফিতির ইতিহাস অনেক পুরনো। এটি মানব সভ্যতার প্রাচীন সময় থেকে চলে আসছে। প্রথম দিকে মানুষ গুহার দেয়ালে চিত্র এঁকে বা খোদাই করে তাদের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির বিবরণ দিত। এই চিত্রগুলিকে আধুনিক গ্রাফিতির প্রাথমিক রূপ বলা যেতে পারে। রোমান এবং মিশরীয় সভ্যতায়, বিভিন্ন বার্তা বা চিত্র খোদাই করা হতো।
আধুনিক গ্রাফিতির সূচনা ঘটে ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকায়। বিশেষত নিউ ইয়র্ক শহরে, যখন তরুণরা তাদের নিজস্ব পরিচিতি প্রকাশের জন্য ট্রেন ও ভবনের দেয়ালে তাদের নাম বা প্রতীক আঁকা শুরু করে। এই ধারা দ্রুত জনপ্রিয় হয় এবং শিল্পের নতুন একটি ধারা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
গ্রাফিতির ধরণ :
গ্রাফিতি বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
- ট্যাগিং (Tagging): এটি সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক রূপ, যেখানে শিল্পী শুধু তাদের নাম বা পরিচিতি স্বাক্ষর করেন।
- থ্রো-আপ (Throw-Up): এটি ট্যাগিং-এর একটি উন্নত রূপ, যেখানে রঙিন অক্ষর এবং দ্রুত আঁকা চিত্র থাকে।
- পিস (Piece): “মাস্টারপিস” এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটি জটিল এবং বিস্তারিত চিত্রকর্ম, যা অনেক সময়সাপেক্ষ।
- স্টেনসিল গ্রাফিতি (Stencil Graffiti): এখানে স্টেনসিল ব্যবহার করে নিখুঁত এবং পুনরাবৃত্ত চিত্র তৈরি করা হয়।
গ্রাফিতি এবং সামাজিক বার্তা :
গ্রাফিতি কেবলমাত্র সৃজনশীলতার প্রকাশ নয়, এটি অনেক সময় সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি, বৈষম্য, এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের মাধ্যম হয়ে ওঠে। বিশ্বজুড়ে গ্রাফিতি শিল্পীরা তাদের কাজের মাধ্যমে শান্তি, সাম্য এবং স্বাধীনতার বার্তা ছড়িয়ে দেয়।
উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত ব্রিটিশ গ্রাফিতি শিল্পী ব্যাংক্সি (Banksy) তার শিল্পকর্মের মাধ্যমে যুদ্ধ, দারিদ্র্য, এবং রাজনৈতিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেন। তার কাজগুলো শুধু শিল্প নয়, বরং গভীর সামাজিক এবং রাজনৈতিক বার্তা বহন করে।
গ্রাফিতি: আইনগত দৃষ্টিভঙ্গি :
অনেক দেশে গ্রাফিতি বেআইনি হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষত যখন এটি অনুমতি ছাড়া প্রকাশ্য স্থানে করা হয়। এটি ভাংচুর বা সম্পত্তি নষ্ট করার সমার্থক বলে ধরা হয়। তবে কিছু দেশ এবং শহরে, অনুমতিপ্রাপ্ত এলাকায় বা “ওয়াল অফ ফেম”-এ গ্রাফিতি করা বৈধ।
বাংলাদেশে গ্রাফিতি :
বাংলাদেশে গ্রাফিতি তেমন প্রচলিত নয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা এবং অন্যান্য বড় শহরগুলিতে গ্রাফিতি এবং ওয়াল আর্টের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। অনেক তরুণ শিল্পী দেয়ালে সামাজিক বার্তা, প্রকৃতির ছবি, বা ঐতিহ্যবাহী চিত্র আঁকছেন। বিশেষ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ এবং ফেস্টিভ্যাল উপলক্ষে দেয়ালে গ্রাফিতির কাজ দেখা যায়।
গ্রাফিতির ভবিষ্যৎ :
প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে গ্রাফিতি এখন ডিজিটাল মাধ্যমেও স্থান করে নিচ্ছে। গ্রাফিতি আর্ট অ্যাপ এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে শিল্পীরা তাদের কাজ বিশ্বব্যাপী প্রদর্শন করতে পারছেন। এর ফলে এই শিল্প ধারা নতুন মাত্রা পাচ্ছে।
উপসংহার :
গ্রাফিতি একটি বহুমুখী শিল্প। এটি শুধুমাত্র একটি দেয়ালে রঙিন চিত্র নয়, বরং মানুষের আবেগ, প্রতিবাদ এবং সৃজনশীলতার প্রকাশ। এটি কালের স্রোতে বিবর্তিত হয়েছে এবং বর্তমান সমাজে এর গভীর প্রভাব রয়েছে। তাই গ্রাফিতি শুধু একটি চিত্রকলার মাধ্যম নয়, বরং একটি শক্তিশালী সামাজিক বার্তাবাহক।