মুরজিয়া শব্দের অর্থ কি

মুরজিয়া (Murji’ah) শব্দটি ইসলামি ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ও দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি মূলত আরবি শব্দ “إرجاء” (Irja’) থেকে এসেছে, যার অর্থ “স্থগিত রাখা” বা “পিছিয়ে দেওয়া”। ইসলামি ইতিহাসে এটি একটি বিশেষ মতবাদ ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাম হিসেবে পরিচিত, যারা বিশ্বাস করত যে ঈমান ও আমলের সম্পর্ক আল্লাহর বিচারের উপর নির্ভরশীল, এবং আমলের ভিত্তিতে কাউকে কাফের বলা উচিত নয়।

মুরজিয়া মতবাদ ইসলামি ইতিহাসের প্রথম দিকের যুগে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং এটি খারিজিদের বিপরীত দৃষ্টিভঙ্গি বহন করত।

মুরজিয়া শব্দের অর্থ ও উৎপত্তি :

মুরজিয়া (Murji’ah) শব্দটি মূলত “إرجاء” (Irja’) থেকে এসেছে, যার অর্থ:

  • স্থগিত রাখা
  • বিলম্ব করা
  • পিছনে রাখা

এই শব্দটি ইসলামের প্রাথমিক যুগে একটি বিশেষ মতবাদ বা বিশ্বাসের ধারকদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। মুরজিয়া মতবাদের অনুসারীরা বিশ্বাস করত যে মানুষের ঈমানের (বিশ্বাসের) চূড়ান্ত বিচার একমাত্র আল্লাহ করবেন এবং কোনো ব্যক্তির পাপের কারণে তাকে কাফের বলা উচিত নয়

মুরজিয়া মতবাদের মূলনীতি :

মুরজিয়া মতবাদের প্রধান কয়েকটি মূলনীতি হলো:

  1. ঈমান ও আমলের পৃথকীকরণ: তারা বিশ্বাস করত যে ঈমান (বিশ্বাস) ও আমল (কর্ম) সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। কেউ পাপে লিপ্ত হলেও যদি তার ঈমান অটুট থাকে, তবে তাকে কাফের বলা যাবে না।
  2. চূড়ান্ত বিচার আল্লাহর হাতে: তারা মনে করত, পাপী মুসলিমদের ঈমানের অবস্থা নির্ধারণ করা কেবলমাত্র আল্লাহর কাজ, মানুষের নয়।
  3. আন্তঃসম্পর্কিত সংযমী দৃষ্টিভঙ্গি: তারা খারিজি মতবাদের বিরোধিতা করত, কারণ খারিজিরা মনে করত, পাপ করলে ঈমান নষ্ট হয়ে যায় এবং ব্যক্তি কাফের হয়ে যায়।
আরো জানুন >>  লংমার্চ মানে কি

মুরজিয়াদের ইসলামের ইতিহাসে ভূমিকা :

মুরজিয়া মতবাদ প্রথম ইসলামি খিলাফতের শুরুর দিকে, বিশেষ করে উমাইয়া খিলাফতের সময় বিকশিত হয়। খারিজিদের উগ্র মতবাদের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে।

ইতিহাসে মুরজিয়াদের ভূমিকা:

খারিজিদের চরমপন্থার বিরোধিতা: খারিজিরা মনে করত, পাপ করলে মানুষ ইসলাম থেকে বেরিয়ে যায়, কিন্তু মুরজিয়ারা এ ধারণার বিরোধিতা করত।
শাসকদের প্রতি সহনশীলতা: তারা শাসকদের প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে চেয়েছিল এবং রাজনৈতিক সংঘাত এড়াতে চেয়েছিল।
আকিদা ও ধর্মতত্ত্বে প্রভাব: তাদের মতবাদ পরবর্তী অনেক ইসলামি চিন্তাধারার উপর প্রভাব বিস্তার করে।

মুরজিয়া মতবাদের সমালোচনা ও প্রভাব :

ইসলামের মূলধারার চিন্তাবিদদের অনেকেই মুরজিয়া মতবাদকে সমালোচনা করেছেন। তাদের মতে, এই মতবাদ পাপ ও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয় এবং ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে কিছুটা বিচ্যুত।

সমালোচনার কারণ:

আমলের গুরুত্ব কমিয়ে দেয়: এই মতবাদ অনুসারে আমল কম গুরুত্ব পায়, যা ইসলামের মূল নীতির পরিপন্থী বলে মনে করা হয়।
শাসকদের প্রতি অতিরিক্ত সহানুভূতি: তারা শাসকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করে নীরব থাকা পছন্দ করত, যা সমাজের দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।

তবে, মুরজিয়াদের কিছু ইতিবাচক প্রভাবও ছিল। তারা ইসলামে সংযম ও সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছিল এবং চরমপন্থার বিপরীতে একটি ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছিল।

উপসংহার :

মুরজিয়া শব্দের অর্থ শুধু “স্থগিত রাখা” নয়, এটি ইসলামের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মতবাদকেও বোঝায়। যদিও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা হয়েছে, তবে এটি ইসলামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। মুরজিয়া মতবাদ খারিজিদের চরমপন্থার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ উদ্ভূত হয়েছিল এবং ইসলামের মধ্যপন্থী চিন্তাধারার বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল।

আরো জানুন >>  পুলক শব্দের অর্থ কি

যদিও বর্তমানে মুরজিয়া মতবাদ সরাসরি অনুসরণ করা হয় না, তবে এর দর্শন ইসলামি চিন্তাধারার বিকাশে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়।

Leave a Comment