ইসলামে নবী ও রাসুল শব্দ দুটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গভীর তাৎপর্য বহন করে। এ দুই শব্দের মধ্যে মিল থাকা সত্ত্বেও, তাদের মধ্যে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে যা ইসলামের বিশ্বাস ও প্রথায় গভীরভাবে নিহিত। এই আর্টিকেলে নবী ও রাসুলের সংজ্ঞা, তাদের ভূমিকা এবং পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হবে।
নবী: সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য:
‘নবী’ শব্দটি আরবি ‘নাবা’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘সংবাদ’ বা ‘বার্তা’। ইসলামী পরিভাষায় নবী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আল্লাহ থেকে বার্তা গ্রহণ করেন এবং মানুষকে তা শিক্ষা দেন। নবী সরাসরি আল্লাহর নির্দেশিত পথে পরিচালিত হন এবং মানুষের জন্য একটি আলোকিত পথের দিশারি হিসেবে কাজ করেন।
নবীদের কিছু বৈশিষ্ট্য:
- নবী আল্লাহর বাণী গ্রহণ করেন, তবে তাঁরা সবসময় নতুন শরীয়ত বা আইন প্রবর্তন করেন না।
- তাঁরা পূর্ববর্তী রাসুলদের বা নবীদের শিক্ষা ও শরীয়তের উপর ভিত্তি করে কাজ করেন।
- নবী সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা জাতির জন্য প্রেরিত হন।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য নবী হলেন আদম (আ.), দাউদ (আ.), এবং সুলাইমান (আ.)। তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে আল্লাহর নির্দেশনা প্রচার করেছেন।
রাসুল: সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য:
‘রাসুল’ শব্দটি আরবি ‘রিসালাহ’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ‘বার্তা’ বা ‘দূত’। রাসুল হলেন এমন একজন নবী, যাঁকে নতুন শরীয়ত বা আইন প্রচারের জন্য প্রেরিত করা হয়। রাসুল সাধারণত বৃহৎ আকারে মানবজাতিকে আহ্বান জানান এবং নতুন একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থের প্রচার করেন।
রাসুলদের কিছু বৈশিষ্ট্য:
- রাসুল সবসময় একটি নতুন শরীয়ত বা আইন নিয়ে আসেন, যা পূর্ববর্তী শরীয়তকে সম্পূর্ণ বা পরিমার্জিত করে।
- রাসুলের বার্তা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের সীমা ছাড়িয়ে সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য হয়।
- রাসুলের জীবনে একটি বিশেষ লক্ষ্য থাকে, যেমন আল্লাহর বার্তাগুলো নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত করা বা একটি জাতির ভুল পথ সংশোধন করা।
উদাহরণ হিসেবে উল্লেখযোগ্য রাসুল হলেন নূহ (আ.), ইবরাহিম (আ.), মুসা (আ.), ঈসা (আ.), এবং শেষ রাসুল মুহাম্মদ (সা.)।
নবী ও রাসুলের মধ্যে পার্থক্য:
নবী ও রাসুলের ভূমিকা এবং দায়িত্বের দিক থেকে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। নিচে তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হলো:
- শরীয়ত প্রবর্তন:
- রাসুল নতুন শরীয়ত প্রবর্তন করেন। নবী পূর্ববর্তী রাসুলের শরীয়তের অনুসারী হন।
- উদাহরণ: মুসা (আ.) তাওরাত নিয়ে এসেছিলেন, যা একটি নতুন শরীয়ত ছিল; অন্যদিকে হারুন (আ.) তাঁর সহযোগী ছিলেন এবং তাওরাতের অনুসারী ছিলেন।
- বার্তার ব্যাপ্তি:
- রাসুলের বার্তা সাধারণত সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
- নবীর বার্তা নির্দিষ্ট সম্প্রদায় বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ থাকে।
- অধিকার ও দায়িত্ব:
- রাসুলের উপর আল্লাহর বাণী পৌঁছানো এবং সেটি প্রতিষ্ঠিত করার দায়িত্ব থাকে।
- নবী প্রধানত মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করেন এবং তাঁদের সতর্ক করেন।
- সংখ্যা ও গুরুত্ব:
- ইসলামের ঐতিহ্য অনুসারে, নবীদের সংখ্যা অনেক বেশি (প্রায় ১,২৪,০০০), তবে রাসুলের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম (প্রায় ৩১৩)।
- পরিচয়ের অনন্যতা:
- রাসুল সবসময় নবী হন, তবে সকল নবী রাসুল হন না। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।
মুহাম্মদ (সা.)-এর ভূমিকা:
মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের শেষ নবী ও রাসুল। তিনি সর্বশেষ শরীয়ত, আল-কুরআন, এবং ইসলামী জীবনব্যবস্থা নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর বার্তা সমগ্র মানবজাতির জন্য এবং কিয়ামত পর্যন্ত প্রযোজ্য। মুহাম্মদ (সা.)-এর মধ্যে নবী এবং রাসুল উভয়ের বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।
উপসংহার:
নবী ও রাসুল ইসলামের দৃষ্টিতে আল্লাহর বিশেষ বাছাই করা ব্যক্তি, যাঁরা মানবজাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, উভয়ের উদ্দেশ্য এক—মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান জানানো এবং তাঁদের মধ্যে নৈতিকতা, ইনসাফ এবং ঈমান প্রতিষ্ঠিত করা। নবী ও রাসুল সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান এবং তাদের ভূমিকার গুরুত্ব বোঝা আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসকে আরও সুদৃঢ় করে এবং মানবিক মূল্যবোধ বাড়ায়।