“রুহ আফজা” (Ruh Afza) নামটি শুনলেই মনে পড়ে এক সুস্বাদু, গোলাপি রঙের শরবতের কথা, যা বহু বছর ধরে উপমহাদেশে গ্রীষ্মের এক অপরিহার্য পানীয় হিসেবে সমাদৃত। তবে এই জনপ্রিয় পানীয়ের নামটি কেবলমাত্র একটি ব্র্যান্ড নয়; এর পেছনে রয়েছে একটি গভীর অর্থ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং আবেগের মেলবন্ধন। এই প্রবন্ধে আমরা “রুহ আফজা” শব্দের অর্থ ও এর সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করব।
“রুহ আফজা” শব্দের অর্থ :
“রুহ আফজা” মূলত ফারসি ভাষার দুটি শব্দের সংমিশ্রণ:
-
রুহ (روح): অর্থ “আত্মা” বা “প্রাণ”
-
আফজা (افزا): অর্থ “বৃদ্ধি করা”, “বর্ধন”, বা “সজীবতা প্রদানকারী”
সরাসরি অনুবাদ করলে, “রুহ আফজা” অর্থ দাঁড়ায়: “আত্মা জাগ্রতকারী” বা “প্রাণ-উদ্দীপক”। অর্থাৎ, এটি এমন একটি পানীয় যা ক্লান্ত আত্মাকে সতেজতা দেয়, দেহ ও মনের পুনরুজ্জীবন ঘটায়।
এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর মূল বৈশিষ্ট্য—শীতলতা, সতেজতা এবং আরামদায়ক প্রশান্তির অনুভব।
ইতিহাস ও উৎপত্তি :
“রুহ আফজা”-এর আবিষ্কার করেন হাকিম হাফিজ আবদুল মজীদ, যিনি ১৯০৬ সালে ভারতের দিল্লিতে হামদর্দ ল্যাবরেটরিজ প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময়ের প্রচণ্ড গ্রীষ্মে শরীরকে শীতল রাখার জন্য একটি ভেষজ পানীয় তৈরি করার লক্ষ্যেই এই পানীয়টির জন্ম। হাকিম সাহেব এটিকে শুধু শরবত হিসেবেই ভাবেননি, বরং একে একটি ইউনানি ওষুধ হিসেবে প্রস্তুত করেছিলেন, যা শরীরের অভ্যন্তরীণ উত্তাপ কমিয়ে স্বস্তি দেয়।
পরবর্তীতে ভারত ভাগের পরে এই পানীয়টি ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে তিনটি আলাদা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
উপাদান ও প্রাকৃতিক গুণাগুণ :
রুহ আফজা-র মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ভেষজ ও প্রাকৃতিক উপাদানসমূহ। এতে সাধারণত ব্যবহার করা হয়:
-
গোলাপজল
-
চন্দন
-
শিমুল ফুল
-
লেবু
-
তরমুজ বীজ
-
কিউকম্বার
-
কমলা ফুল
-
মিন্ট
-
লবঙ্গ
-
গন্ধরাজ ফুল
-
শীতল ভেষজ উপাদান
এই উপাদানগুলো শরীরকে ঠাণ্ডা রাখে, রক্ত পরিষ্কার করে এবং হজমে সহায়তা করে। রমজানে ইফতারের সময় রুহ আফজা পান করা অনেকের জন্য একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এটি দ্রুত শরীরের পানিশূন্যতা পূরণ করে।
সংস্কৃতি ও জনপ্রিয়তা :
রুহ আফজা কেবল একটি পানীয় নয়, বরং এটি উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির একটি অংশ। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের বহু ঘরে এটি শুধু পানীয় নয়, বরং মিষ্টি, ফিরনি, লাচ্ছি, দই এবং আইসক্রিমের সাথেও মেশানো হয়।
বিশেষত রমজান মাসে রুহ আফজার চাহিদা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। এটি ইফতারের টেবিলে এমন এক পানীয় যার উপস্থিতি প্রায় অপরিহার্য। অনেক পরিবারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই পানীয়ের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আবেগ, স্মৃতি ও ঐতিহ্য।
উপসংহার :
“রুহ আফজা” শব্দটি শুধু একটি পানীয়ের নাম নয়, বরং তা বহন করে ঐতিহ্য, বিশুদ্ধতা, সতেজতা এবং আত্মিক প্রশান্তির প্রতীক। এর অর্থ “আত্মা জাগ্রতকারী” হোক বা “প্রাণবর্ধক”, এই নামটির মধ্যে যে সৌন্দর্য ও ভারসাম্য লুকিয়ে আছে, তা বহু মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল, রমজান কিংবা অতিথি আপ্যায়নের সময় রুহ আফজার ব্যবহার একটি চিরাচরিত অভ্যাস। নামটির মতোই এর স্বাদও আত্মা ছুঁয়ে যায়—এ যেন সত্যিই প্রাণ জাগানো এক অভিজ্ঞতা।