প্রকৃতিতে বিদ্যমান অসংখ্য জীবের মধ্যে শৈবাল (Algae) ও ছত্রাক (Fungi) দুটি গুরুত্বপূর্ণ জীবগোষ্ঠী। উভয়েই উদ্ভিদজগতের অন্তর্ভুক্ত না হলেও এদের অনেক বৈশিষ্ট্য উদ্ভিদের সাথে মিল রয়েছে। তবে এদের মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্যও বিদ্যমান, যা তাদের শ্রেণীবিন্যাস, গঠন, পুষ্টি গ্রহণ পদ্ধতি, পরিবেশগত ভূমিকা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রকাশ পায়।
এই প্রবন্ধে আমরা শৈবাল ও ছত্রাকের সংজ্ঞা, শ্রেণীবিভাগ, গঠন, পুষ্টি গ্রহণ প্রক্রিয়া, পরিবেশগত গুরুত্ব এবং পার্থক্য নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
শৈবাল (Algae) কি ?
শৈবাল হলো এক ধরনের সরল, প্রধানত জলজ, সালোকসংশ্লেষণকারী জীব যা ক্লোরোফিলের উপস্থিতির কারণে নিজেই খাদ্য তৈরি করতে সক্ষম। এটি প্রাকৃতিক পরিবেশে অক্সিজেন উৎপাদন এবং খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
শৈবালের বৈশিষ্ট্য:
- অটোট্রফিক (Autotrophic) পুষ্টি গ্রহণ: শৈবাল সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিজেই খাদ্য তৈরি করতে পারে।
- ক্লোরোফিলের উপস্থিতি: অধিকাংশ শৈবালের কোষে ক্লোরোফিল থাকে, যা সালোকসংশ্লেষণের জন্য প্রয়োজনীয়।
- এককোষী ও বহুকোষী হতে পারে: শৈবাল এককোষী যেমন Chlamydomonas, বহুকোষী যেমন Spirogyra হতে পারে।
- জলজ পরিবেশে বসবাস: শৈবাল প্রধানত জলজ, তবে আর্দ্র স্থানে এবং মাটির উপরও পাওয়া যেতে পারে।
- প্রজনন পদ্ধতি: শৈবাল অযৌন (বাইনারি বিভাজন, স্পোর গঠন) ও যৌন (গ্যামেট সংযুক্তি) উভয় প্রকার প্রজনন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বংশবিস্তার করে।
- শ্রেণীবিন্যাস:
- নীল-সবুজ শৈবাল (Cyanobacteria): উদাহরণ – Nostoc, Anabaena
- সবুজ শৈবাল (Chlorophyceae): উদাহরণ – Chlamydomonas, Spirogyra
- লাল শৈবাল (Rhodophyceae): উদাহরণ – Polysiphonia
- বাদামী শৈবাল (Phaeophyceae): উদাহরণ – Laminaria, Sargassum
ছত্রাক (Fungi) কি ?
ছত্রাক হলো এক ধরনের জীব, যা প্রধানত মৃত বা জৈব পদার্থ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে এবং বংশবিস্তার করে। ছত্রাক সালোকসংশ্লেষণ করতে পারে না এবং এটি জীবদেহের পচন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ছত্রাকের বৈশিষ্ট্য:
- হেটেরোট্রফিক (Heterotrophic) পুষ্টি গ্রহণ: ছত্রাক নিজে খাদ্য তৈরি করতে পারে না; এটি মৃতজৈব পদার্থ থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে (স্যাপ্রোফাইটিক), অন্য জীবের উপর পরজীবী হিসেবে বেঁচে থাকতে পারে (পরজীবী) বা পারস্পরিক সম্পর্কেও বাস করতে পারে (সহাবস্থান)।
- ক্লোরোফিলের অনুপস্থিতি: ছত্রাকের মধ্যে সালোকসংশ্লেষণ করার উপাদান নেই, তাই এটি নিজেই খাদ্য তৈরি করতে পারে না।
- এককোষী ও বহুকোষী হতে পারে: উদাহরণস্বরূপ, ইস্ট (Yeast) এককোষী, কিন্তু মোল্ড (Mold) ও মাশরুম (Mushroom) বহুকোষী।
- শুকনো ও আর্দ্র স্থানে বসবাস: ছত্রাক সাধারণত উষ্ণ, আর্দ্র পরিবেশে বেড়ে ওঠে।
- প্রজনন পদ্ধতি: ছত্রাক প্রধানত স্পোর (Spores) এর মাধ্যমে বংশবিস্তার করে, যা অযৌন এবং যৌন উভয় প্রকার হতে পারে।
- শ্রেণীবিন্যাস:
- জাইগোমাইসেটস (Zygomycetes): উদাহরণ – Rhizopus (ব্রেড মোল্ড)
- অ্যাসকোমাইসেটস (Ascomycetes): উদাহরণ – Saccharomyces (ইস্ট)
- বাসিডিওমাইসেটস (Basidiomycetes): উদাহরণ – Agaricus (মাশরুম)
- ডিউটারোমাইসেটস (Deuteromycetes): উদাহরণ – Penicillium
শৈবাল ও ছত্রাকের মধ্যে পার্থক্যঃ
বৈশিষ্ট্য | শৈবাল (Algae) | ছত্রাক (Fungi) |
---|---|---|
পুষ্টি গ্রহণ | সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে নিজে খাদ্য তৈরি করে (অটোট্রফিক) | মৃতজৈব পদার্থ বা অন্য জীবের ওপর নির্ভরশীল (হেটেরোট্রফিক) |
ক্লোরোফিল | থাকে | থাকে না |
কোষপ্রাচীর উপাদান | সেলুলোজ | কাইটিন |
বসবাসের স্থান | জলজ পরিবেশে বেশি পাওয়া যায় | আর্দ্র, শুকনো এবং মৃতজৈব পদার্থের ওপর জন্মায় |
প্রজনন | স্পোর, গ্যামেট সংযুক্তি বা বিভাজন | স্পোর গঠনের মাধ্যমে |
কোষের সংখ্যা | এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে | এককোষী বা বহুকোষী হতে পারে |
পরিবেশগত ভূমিকা | অক্সিজেন উৎপাদন, খাদ্য শৃঙ্খলে গুরুত্বপূর্ণ | জৈব পদার্থ পচিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য করে তোলে |
শৈবাল ও ছত্রাকের পারস্পরিক সম্পর্ক :
শৈবাল ও ছত্রাক একসাথে বসবাস করে লাইকেন (Lichen) তৈরি করে, যা একটি সহবাসী (Symbiotic) সম্পর্ক। এখানে শৈবাল সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে খাদ্য তৈরি করে এবং ছত্রাক আশ্রয় ও পানি সরবরাহ করে।
উপসংহার :
শৈবাল এবং ছত্রাক উভয়ই জীবজগতের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শৈবাল প্রধানত সালোকসংশ্লেষণকারী এবং জলজ পরিবেশে বসবাস করে, যেখানে ছত্রাক মৃতজৈব পদার্থ থেকে খাদ্য গ্রহণ করে এবং মূলত স্থলজ পরিবেশে পাওয়া যায়।
তাদের মৌলিক পার্থক্য থাকলেও উভয়েই পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে, লাইকেন গঠনের মাধ্যমে তারা পরস্পরের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপন করে, যা প্রকৃতির অন্যতম চমৎকার দৃষ্টান্ত।