ইসলামি পরিভাষায় কিছু শব্দ রয়েছে, যা কেবল ধর্মীয় অর্থে নয়, বরং সমাজ ও জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনই একটি শব্দ হলো “তাগুত”। এই শব্দটি ইসলামী দর্শন ও আকিদার (বিশ্বাসের) একটি মৌলিক অংশ, যা কুরআন ও হাদিসে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তাগুত’ শব্দের অর্থ, এর ব্যবহার, ইসলামে এর গুরুত্ব, কুরআনের আলোকে এর ব্যাখ্যা এবং বাস্তব জীবনে এর প্রভাব নিয়ে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করব।
তাগুত শব্দের অর্থ:
‘তাগুত’ শব্দটি আরবি “طاغوت” (Tāghūt) থেকে এসেছে। এর মূল অর্থ হলো সীমালঙ্ঘনকারী, অত্যাচারী, পথভ্রষ্টকারী বা এমন কিছু যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে যায়।
তাগুত শব্দের বিভিন্ন অর্থ:
- সীমালঙ্ঘনকারী – যে ব্যক্তি বা শক্তি আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করে।
- মিথ্যা দেবতা বা প্রতিমা – যে কোনো মিথ্যা উপাস্য বা ধর্মবিরোধী বিশ্বাস।
- শয়তান – যে মানুষকে সঠিক পথ থেকে বিভ্রান্ত করে।
- অত্যাচারী শাসক – যে ন্যায়বিচারের বিরোধিতা করে এবং মানুষের উপর অন্যায় শাসন চাপিয়ে দেয়।
- ভ্রান্ত মতবাদ ও আদর্শ – এমন কোনো মতবাদ বা আদর্শ, যা ইসলামের সত্যিকার শিক্ষার পরিপন্থী।
কুরআনে তাগুতের উল্লেখ:
কুরআনে ‘তাগুত’ শব্দটি বহুবার এসেছে, এবং প্রতিবারই এটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
১. আল্লাহ তাগুতের ইবাদত নিষিদ্ধ করেছেন:
“যারা ঈমান এনেছে, তারা আল্লাহর দিকে ধাবিত হয়; আর যারা কুফর করেছে, তারা তাগুতের দিকে ধাবিত হয়।”
– (সূরা বাকারা: ২৫৭)
এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, তাগুতের অনুসারীরা আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং ভ্রষ্টতার দিকে ধাবিত হয়।
২. সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য:
“আমরা প্রত্যেক জাতির কাছে একজন রাসূল প্রেরণ করেছি, (যিনি বলেছেন) তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।”
– (সূরা নাহল: ৩৬)
এই আয়াত অনুযায়ী, তাগুত বর্জন করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অপরিহার্য।
তাগুতের ধরন:
তাগুত বিভিন্ন রূপে সমাজে বিদ্যমান থাকতে পারে। এগুলো নিম্নরূপ:
১. শয়তান ও জিন জাতি:
শয়তান হচ্ছে প্রধান তাগুত, কারণ সে মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে নেয়।
২. মিথ্যা উপাস্য ও ধর্মীয় বিভ্রান্তি:
যে কোনো মিথ্যা উপাস্য বা ধর্মীয় গোঁড়ামি, যা ইসলামের মূল শিক্ষার বিরুদ্ধে যায়, তা তাগুত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
৩. অত্যাচারী শাসক ও আইন:
যেসব শাসক ইসলামের বিধান অমান্য করে এবং নিজেদের স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে, তারা তাগুত হিসেবে বিবেচিত হয়।
৪. বিভ্রান্ত মতবাদ ও আদর্শবাদ:
সেকুলারিজম, কমিউনিজম, লিবারেলিজম, নাস্তিকতা ইত্যাদি মতবাদ, যা মানুষকে ইসলামের পথ থেকে সরিয়ে রাখে, তাগুত হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
তাগুত থেকে বাঁচার উপায়:
তাগুত থেকে বাঁচতে হলে একজন মুসলমানকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
১. একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করা:
আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্তাকে উপাস্য বা কর্তৃত্বকারী হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না।
২. কুরআন ও হাদিস অনুযায়ী জীবন পরিচালনা করা:
তাগুত থেকে বাঁচার জন্য ইসলামের মূল শিক্ষাগুলো অনুসরণ করা জরুরি।
৩. অন্যায় ও মিথ্যার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া:
অত্যাচারী শাসক, অন্যায় আইন ও ভ্রান্ত মতবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ইসলামের অন্যতম শিক্ষা।
৪. ইসলামের শুদ্ধ আকিদা ধারণ করা:
বিশুদ্ধ ইসলামী আকিদা (বিশ্বাস) ও তাওহিদের উপর দৃঢ় থাকা তাগুত থেকে বাঁচার প্রধান উপায়।
উপসংহার:
‘তাগুত’ শব্দটি ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ধারণা, যা মুসলমানদের সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য বুঝতে সাহায্য করে। তাগুত হলো এমন কোনো ব্যক্তি, শক্তি বা মতবাদ, যা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। কুরআন ও হাদিসে বারবার তাগুতকে বর্জন করার আদেশ দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থী। একজন প্রকৃত মুসলমানের উচিত তাগুতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এবং আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস রাখা। যদি আমরা তাগুত থেকে দূরে থাকতে পারি, তবে আমরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী হতে পারব এবং দুনিয়া ও আখিরাতে সফলতা অর্জন করতে পারব।