টোডরমল কে ছিলেন

ভারতীয় ইতিহাসে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থার নির্মাতা ছিলেন সম্রাট আকবর। তার শাসনামলে প্রশাসনিক কাঠামোকে সুসংগঠিত করতে একাধিক দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তি কাজ করেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজা টোডরমল। তিনি মূলত মুঘল সাম্রাজ্যের রাজস্ব প্রশাসনের সংস্কারক হিসেবে ইতিহাসে বিশেষভাবে স্মরণীয়। তার অবদান শুধু আকবরের আমলেই নয়, পরবর্তী মুঘল শাসকদের আমলেও রাজস্ব প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

টোডরমল কে ছিলেন:

রাজা টোডরমলের জন্ম ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে ভারতের উত্তর প্রদেশে একটি কায়স্থ পরিবারে হয়েছিল। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও প্রশাসনিক দক্ষতায় অনন্য। মুঘল সাম্রাজ্যের প্রথম দিকে তিনি শের শাহ সুরির অধীনে কাজ শুরু করেন এবং পরবর্তীতে সম্রাট আকবরের অন্যতম প্রধান মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। তার দক্ষতার কারণে তাকে রাজা উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

রাজস্ব প্রশাসনে টোডরমলের অবদান:

টোডরমল প্রধানত রাজস্ব প্রশাসনের দক্ষ ব্যবস্থাপক ছিলেন। তার হাত ধরেই আকবরের আমলে রাজস্ব ব্যবস্থার এক বড়সড় সংস্কার সাধিত হয়।

১. জমির পরিমাপ ও শ্রেণিবিন্যাস:

টোডরমল ভারতের জমির সঠিক পরিমাপ এবং শ্রেণিবিন্যাসের জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম চালু করেন। তিনি সম্পূর্ণ সাম্রাজ্যের জমিকে তিনটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত করেন:
✅ পোলোজ (Polaj): উর্বর জমি, যেখানে প্রতি বছর ফসল চাষ করা যায়।
✅ পরাউতি (Parauti): এমন জমি, যেখানে এক বা একাধিক বছর বিরতি দিয়ে চাষ করা হয়।
✅ চারাই (Chachar): অনাবাদী জমি, যেখানে দীর্ঘকাল ধরে কোনো চাষাবাদ হয় না।

এই শ্রেণিবিভাগের মাধ্যমে কর ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ ও কার্যকর হয়।

২. “জাবতি” ব্যবস্থা প্রবর্তন:

রাজা টোডরমল “জাবতি” নামে একটি নতুন রাজস্ব ব্যবস্থা চালু করেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে গড় উৎপাদন হার হিসাব করে কৃষকদের উপর কর ধার্য করা হতো। এতে নির্দিষ্ট হারে কর নির্ধারিত হওয়ায় কৃষকদের উপর অত্যধিক করের বোঝা চাপত না।

৩. “দশালা” পদ্ধতি:

টোডরমল দশালা নামে একটি নতুন রাজস্ব পদ্ধতি প্রবর্তন করেন, যেখানে পূর্ববর্তী দশ বছরের উৎপাদনের গড় হিসাব করে কর নির্ধারণ করা হতো। এতে কৃষকদের উপর করের বোঝা কম পড়ে এবং সামগ্রিক রাজস্ব আদায়ও নিশ্চিত করা যেত।

৪. কর সংগ্রহের নিয়মনীতি:

রাজস্ব সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি আরও কিছু সংস্কার করেন, যেমন:
🔹 কর প্রদান নগদ অর্থে গ্রহণের ব্যবস্থা করা, যাতে কৃষকরা সুবিধাজনকভাবে পরিশোধ করতে পারেন।
🔹 রাজস্ব কর্মকর্তাদের জন্য নিয়মিত পরিদর্শন ও তদারকি ব্যবস্থা চালু করা।
🔹 কৃষকদের কাছ থেকে অন্যায়ভাবে অতিরিক্ত কর আদায় করা নিষিদ্ধ করা।

টোডরমলের প্রভাব ও উত্তরাধিকার:

টোডরমলের রাজস্ব ব্যবস্থার ফলে মুঘল সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত হয় এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। তার রাজস্ব সংস্কার শুধু আকবরের আমলেই নয়, বরং পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের সময়েও অনুসরণ করা হয়েছে। এমনকি ব্রিটিশ আমলেও তার তৈরি করা প্রশাসনিক কাঠামোর কিছু নীতি অনুসৃত হয়েছিল।

উপসংহার:

রাজা টোডরমল শুধুমাত্র একজন দক্ষ রাজস্ব প্রশাসকই ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একজন বিচক্ষণ নীতিনির্ধারক। তার প্রবর্তিত জমি পরিমাপ, কর নির্ধারণ ও রাজস্ব আদায়ের ব্যবস্থা ভারতের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয়। তার অবদান ভারতীয় রাজস্ব প্রশাসনের ক্ষেত্রে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।