জাহেলিয়া (جاهلية) একটি আরবি শব্দ, যা ইসলামের পূর্ববর্তী আরব সমাজের একটি নির্দিষ্ট সময়কালকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দের মূল অর্থ “অজ্ঞতা” বা “অজ্ঞানতার যুগ।” ইসলামি সাহিত্য ও ইতিহাসে এটি সেই সময়ের দিকে ইঙ্গিত করে যখন আরব সমাজে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, নৈতিক অবক্ষয়, এবং অরাজকতা বিরাজ করত।
জাহেলিয়া শব্দের অর্থ :
১. শব্দমূল:
“জাহেলিয়া” শব্দটি আরবি শব্দ “জাহল” (جهل) থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ “অজ্ঞতা” বা “অজ্ঞানতা।” এটি এমন একটি অবস্থা বোঝায় যেখানে মানুষ সঠিক জ্ঞান বা সঠিক দিকনির্দেশনা ছাড়াই জীবনযাপন করে।
২. পরিভাষিক অর্থ:
ইসলামের দৃষ্টিতে, “জাহেলিয়া” হলো এমন একটি যুগ যখন মানুষ স্রষ্টার একত্ববাদের ধারণা থেকে বিচ্যুত হয়ে মূর্তিপূজা, কুসংস্কার, এবং অশান্তিমূলক কার্যকলাপে লিপ্ত ছিল। এটি শুধু ধর্মীয় অজ্ঞতা নয়, বরং নৈতিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের সময়কেও বোঝায়।
জাহেলিয়া যুগের বৈশিষ্ট্য :
জাহেলিয়ার যুগের আরব সমাজের কিছু মূল বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ:
১. ধর্মীয় অজ্ঞতা ও মূর্তিপূজা:
জাহেলিয়া যুগে আরব সমাজ বহু ঈশ্বরবাদে বিশ্বাস করত। কাবাঘর, যা আজ ইসলামের পবিত্র স্থান, তখন বিভিন্ন মূর্তির পূজা করার কেন্দ্র ছিল। আরবরা সৃষ্টিকর্তার ধারণা সম্পর্কে জানলেও তারা একত্ববাদে বিশ্বাসী ছিল না।
২. নারীদের প্রতি বৈষম্য:
জাহেলিয়া যুগে নারীদের অবস্থা অত্যন্ত করুণ ছিল। কন্যাসন্তান জন্ম হলে অনেক পরিবার তাদের জীবন্ত কবর দিয়ে দিত। নারীদের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার ছিল অত্যন্ত সীমিত।
৩. অনৈতিকতা ও অসামাজিক কার্যকলাপ:
সে সময় সমাজে মদ্যপান, জুয়া, ব্যভিচার এবং চুরি খুবই সাধারণ ছিল। লোকেরা নিজেদের ইচ্ছামতো জীবনযাপন করত, এবং নৈতিক মূল্যবোধ ছিল প্রায় অনুপস্থিত।
৪. সামাজিক বিভাজন:
আরব সমাজ তখন বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি গোত্র নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় লিপ্ত থাকত, এবং এই বিভাজন প্রায়শই সংঘর্ষের কারণ হতো।
৫. শিক্ষার অভাব:
জাহেলিয়া যুগে লেখাপড়ার প্রচলন খুবই সীমিত ছিল। বেশিরভাগ মানুষ নিরক্ষর ছিল, এবং তাদের মধ্যে জ্ঞানার্জনের প্রবণতা তেমন দেখা যেত না।
ইসলাম আগমনের প্রভাব :
ইসলাম জাহেলিয়া যুগের অবসান ঘটিয়ে একটি নৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় বিপ্লব ঘটায়। নবী মুহাম্মদ (সা.) এর প্রচারিত বার্তা ছিল:
- এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা।
- নৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
- কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা দূর করা।
- নারী ও পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করা।
জাহেলিয়া শব্দের প্রসঙ্গ :
ইসলামি সাহিত্য ও কোরআনে “জাহেলিয়া” শব্দটি কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন:
- কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস: জাহেলিয়া যুগে মানুষ অন্ধ বিশ্বাসে আবদ্ধ ছিল, যা তাদের জীবনে নৈতিকতার অভাব তৈরি করেছিল।
- নৈতিক অবক্ষয়: ইসলামি দৃষ্টিতে জাহেলিয়া হলো সেই সময় যখন মানবজাতি সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত ছিল।
কোরআনের একটি উল্লেখযোগ্য আয়াত হলো:
“তারা কি জাহেলিয়ার যুগের বিধানের অনুসরণ করতে চায়? নিশ্চয়ই যারা দৃঢ় বিশ্বাসী তাদের জন্য আল্লাহর বিধান অপেক্ষা উত্তম।”
— সূরা আল-মায়েদা (৫:৫০)
আধুনিক যুগে জাহেলিয়া :
আজকের যুগেও অনেক সমাজে জাহেলিয়ার কিছু বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। নৈতিক অবক্ষয়, ধর্মীয় বিভ্রান্তি, এবং সামাজিক অন্যায় দেখা যায়। ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে, আধুনিক সমাজে নৈতিক ও ধর্মীয় অবক্ষয়কে “আধুনিক জাহেলিয়া” হিসেবে দেখা যেতে পারে।
উপসংহার :
জাহেলিয়া শব্দটি শুধু ইসলামের পূর্ববর্তী সময়ের অজ্ঞতা বোঝায় না, বরং এটি নৈতিক, সামাজিক, এবং ধর্মীয় দিক থেকে ভুল পথ অনুসরণ করার একটি প্রতীক। ইসলাম সেই অজ্ঞতার যুগের অবসান ঘটিয়ে মানবজাতিকে জ্ঞান, ন্যায়বিচার, এবং এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের পথে নিয়ে আসে। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে নৈতিকতা ও জ্ঞানের পথে চলা সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।