‘জুলমাত’ (ظلمات) একটি আরবি শব্দ, যা মূলত কোরআন ও ইসলামী সাহিত্যতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এটি একবচনে ‘জুলমাহ’ (ظلمة) শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ অন্ধকার। জুলমাত হলো এর বহুবচন রূপ, যার অর্থ একাধিক স্তরের অন্ধকার বা গভীর অন্ধকার। কোরআনে এই শব্দটি বিভিন্ন প্রসঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে, যেখানে এটি আক্ষরিক ও রূপক অর্থ বহন করে।
জুলমাত শব্দের অর্থ :
জুলমাত শব্দটি সাধারণত নিম্নলিখিত অর্থে ব্যবহৃত হয়:
- শারীরিক বা প্রাকৃতিক অন্ধকার – যেখানে আলো অনুপস্থিত, যেমন গভীর রাত বা সমুদ্রের অতল গভীরতা।
- আত্মিক বা আধ্যাত্মিক অন্ধকার – যেখানে মানুষ পথভ্রষ্ট হয়ে যায়, সত্য থেকে বিচ্যুত হয় এবং অজ্ঞতা বা কুসংস্কারে নিমজ্জিত থাকে।
- অন্যায় ও অবিচারের অন্ধকার – যেখানে অত্যাচার, শোষণ ও অবিচারের মাধ্যমে সমাজ বা ব্যক্তিকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করা হয়।
কোরআনে জুলমাত শব্দের ব্যবহার :
কোরআনে ‘জুলমাত’ শব্দটি প্রায়শই আলো (নূর) এর বিপরীতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা সত্য ও জ্ঞানের প্রতীক। যেমন:
اللَّهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ
“আল্লাহ মুমিনদের অভিভাবক; তিনি তাদের অন্ধকার (জুলমাত) থেকে আলোতে (নূর) নিয়ে আসেন।” (সূরা আল-বাকারা: ২৫৭)
এই আয়াতে ‘জুলমাত’ শব্দটি ভ্রান্তি, পাপ এবং পথভ্রষ্টতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, যেখানে আল্লাহ মানুষের জন্য মুক্তির আলো প্রদান করেন।
জুলমাতের বিভিন্ন রূপ :
জুলমাত বিভিন্ন ধরণের হতে পারে, যা মানুষের জীবন ও সমাজে গভীর প্রভাব ফেলে।
১. আত্মিক জুলমাত (Spiritual Darkness):
এটি এমন এক অবস্থা যেখানে মানুষ সঠিক পথ হারিয়ে ফেলে, পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং সত্য থেকে দূরে সরে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যারা সত্যকে অস্বীকার করে, তারা অজ্ঞতা ও সন্দেহের অন্ধকারে থাকে।
২. সামাজিক জুলমাত (Social Darkness):
যখন সমাজে অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও বৈষম্য ছড়িয়ে পড়ে, তখন সমাজ একপ্রকার ‘জুলমাত’-এর মধ্যে পড়ে। দুর্নীতি, যুদ্ধ, দাসত্ব, এবং দারিদ্র্য হলো সামাজিক জুলমাতের কিছু উদাহরণ।
৩. মানসিক জুলমাত (Psychological Darkness):
কখনো কখনো মানুষ হতাশা, ভয়, উদ্বেগ বা অজ্ঞতার কারণে একধরনের মানসিক অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এটি আত্মবিশ্বাসের অভাব, নেতিবাচক চিন্তা এবং হতাশার কারণে হতে পারে।
৪. রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জুলমাত (Political & Economic Darkness):
যখন কোনো দেশ বা সমাজ দুর্নীতি, স্বৈরাচারী শাসন এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে পড়ে, তখন তা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জুলমাতের শিকার হয়। ইতিহাসে বহু জাতি রাজনৈতিক অন্ধকারে ডুবে গিয়ে ধ্বংস হয়েছে।
জুলমাত থেকে মুক্তির উপায় :
যেকোনো ধরণের জুলমাত থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়োজন সত্য, জ্ঞান ও নৈতিকতার আলো। নিম্নলিখিত উপায়গুলো এই অন্ধকার থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে পারে:
- আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও ধর্মীয় অনুশীলন: ঈমান, নামাজ, কোরআন অধ্যয়ন এবং আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ করলে মানুষ সত্যের আলো খুঁজে পায়।
- শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন: অজ্ঞতা ও কুসংস্কার দূর করার জন্য জ্ঞানার্জন অপরিহার্য। শিক্ষা সমাজকে আলো দেখায়।
- ন্যায়পরায়ণতা ও সুবিচার: সামাজিক ও রাজনৈতিক জুলমাত দূর করার জন্য সুবিচার ও সততার চর্চা করা জরুরি।
- আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব: মানসিক জুলমাত থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এবং নেতিবাচক চিন্তাকে দূরে রাখতে হবে।
- সচেতনতা ও সামাজিক পরিবর্তন: দুর্নীতি, বৈষম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি করে সমাজের অন্ধকার দূর করা সম্ভব।
উপসংহার :
জুলমাত কেবল শারীরিক অন্ধকার নয়, বরং এটি আত্মিক, সামাজিক, মানসিক এবং রাজনৈতিক দিক থেকেও গভীর অর্থ বহন করে। এটি অজ্ঞতা, অন্যায় ও অবিচারের প্রতীক, যা থেকে মুক্তির জন্য সত্য, জ্ঞান ও ন্যায়বিচারের আলো প্রয়োজন। কোরআনে বারবার বলা হয়েছে যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জুলমাত থেকে মুক্তি দিয়ে নূরের পথে নিয়ে যান। তাই আমাদের উচিত নিজেদের জীবন ও সমাজকে আলোতে নিয়ে আসার জন্য শিক্ষা, ন্যায়পরায়ণতা ও সৎ জীবনযাত্রার অনুসরণ করা।