লাইলাতুল বরাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক রজনী, যা মুসলিম সমাজে বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। এটি শাবান মাসের ১৪ তারিখের রাত, যা “শবে বরাত” নামেও পরিচিত। ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, এই রাতে আল্লাহ তাআলা বান্দাদের গুনাহ মাফ করেন, রিজিক নির্ধারণ করেন এবং আগামী বছরের ভাগ্য লিখে দেন।
লাইলাতুল বরাত শব্দের অর্থঃ
“লাইলাতুল বরাত” আরবি শব্দগুচ্ছের সমন্বয়ে গঠিত।
- লাইলাতুন (لَيْلَةٌ) অর্থ “রাত”।
- বরাত (البراءة) অর্থ “মুক্তি” বা “নাজাত”।
অর্থাৎ, “লাইলাতুল বরাত” শব্দের অর্থ দাঁড়ায় “মুক্তির রাত” বা “নাজাতের রাত”। এই রাতকে পাপমুক্তির, গুনাহ মাফের এবং ভাগ্য নির্ধারণের রাত হিসেবে গণ্য করা হয়।
লাইলাতুল বরাতের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
১. গুনাহ থেকে মুক্তি পাওয়ার সুযোগ:
ইসলামের বিভিন্ন হাদিস ও ব্যাখ্যার আলোকে জানা যায় যে, লাইলাতুল বরাত এমন একটি রাত যখন আল্লাহ অসংখ্য বান্দাকে গুনাহ মুক্ত করে দেন। যারা অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ তাদের গুনাহ ক্ষমা করেন।
২. রিজিক, মৃত্যু ও ভাগ্য নির্ধারণ:
অনেক ইসলামিক ব্যাখ্যার মতে, এই রাতে আগামী বছরের রিজিক, মৃত্যু এবং ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়। যদিও চূড়ান্ত ভাগ্য আল্লাহর আদেশ অনুসারে বদলানো সম্ভব, তবুও এই রাতে বান্দার জন্য বিভিন্ন বিধান নির্ধারিত হয় বলে অনেক আলেম মত প্রকাশ করেছেন।
৩. রহমত ও দোয়ার রাত:
লাইলাতুল বরাত একটি বিশেষ রহমতের রাত, যখন আল্লাহ তাঁর দয়া ও করুণা বর্ষণ করেন। যারা আন্তরিকভাবে দোয়া করে, আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন। এই রাতে বেশি বেশি ইবাদত, কুরআন তেলাওয়াত এবং জিকির করা সুন্নত হিসেবে গণ্য হয়।
হাদিস ও লাইলাতুল বরাতঃ
লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে বিভিন্ন হাদিস পাওয়া যায়, যার মধ্যে কিছু গ্রহণযোগ্য এবং কিছু সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে।
১. গুনাহ মাফের হাদিস:
হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“শাবান মাসের মধ্যরাতে আল্লাহ তাআলা প্রথম আসমানে নেমে আসেন এবং ঘোষণা করেন—
‘আছে কি কেউ ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করব।
আছে কি কেউ রিজিক চাওয়ার? আমি তাকে রিজিক দেব।
আছে কি কেউ বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে মুক্তি দেব।’
এবং এভাবেই সুবহে সাদিক পর্যন্ত তিনি ডাক দিতে থাকেন।” (ইবনে মাজাহ)
২. গুনাহ মাফ ও শিরকের সতর্কবার্তা:
অন্য এক হাদিসে উল্লেখ আছে,
“আল্লাহ তাআলা শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাতে তাঁর সৃষ্টিকুলের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।” (ইবনে মাজাহ)
লাইলাতুল বরাতের ইবাদত ও আমলঃ
১. নফল নামাজ:
এই রাতে নফল নামাজ আদায় করা উত্তম। অনেকে দুই রাকাত করে বিভিন্ন পরিমাণে নামাজ পড়েন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করেন।
২. কুরআন তেলাওয়াত:
পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করা লাইলাতুল বরাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আমল। এই রাতে সূরা ইয়াসিন, সূরা মুলক, সূরা দুখান পড়া অনেক ফজিলতপূর্ণ।
- তওবা ও ইস্তিগফার:
এই রাতে আল্লাহর কাছে নিজের সকল পাপের জন্য ক্ষমা চেয়ে তওবা করা উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেন,
“হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” (সূরা যুমার: ৫৩)
৪. রোজার প্রস্তুতি:
অনেক সাহাবি ও ইসলামি স্কলারগণ বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) শাবান মাসের ১৫ তারিখে নফল রোজা রাখতেন। তাই কেউ চাইলে পরদিন রোজা রাখতে পারেন।
লাইলাতুল বরাত সম্পর্কে বিতর্কঃ
কিছু আলেম মনে করেন, লাইলাতুল বরাতের ফজিলত সম্পর্কে শক্তিশালী হাদিস কম রয়েছে, তাই এটাকে বিশেষভাবে উদযাপন না করাই উত্তম। অন্যদিকে, অধিকাংশ ইসলামি স্কলাররা একে গুনাহ মাফের রাত হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকেন।
উপসংহারঃ
লাইলাতুল বরাত ইসলামের একটি পবিত্র ও রহমতের রাত, যেখানে বান্দাদের জন্য গুনাহ মুক্তির, দোয়া কবুলের এবং ভাগ্য নির্ধারণের বিশেষ সুযোগ রয়েছে। তাই এই রাতে ইবাদত-বন্দেগিতে মগ্ন হওয়া, আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করা এবং পরিশুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।