সহধর্মিণী শব্দটি বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত একটি বিশেষ শব্দ যা সাধারণত স্ত্রী বা পত্নীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। এই শব্দটি দুটি অংশে বিভক্ত – ‘সহ’ এবং ‘ধর্মিণী’। ‘সহ’ মানে সঙ্গে বা সহিত এবং ‘ধর্মিণী’ মানে ধর্মের অনুসারিণী বা ধারিণী। অর্থাৎ, সহধর্মিণী মানে সেই নারী যিনি তার স্বামীর সঙ্গে ধর্ম, কর্ম এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করেন।
সহধর্মিণীর সংজ্ঞা ও প্রেক্ষাপট :
সহধর্মিণী শব্দটি মূলত পারিবারিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয়। এটি স্ত্রী বা পত্নীকে বোঝায় যিনি তার স্বামীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং সকল কাজে সহায়ক। এই শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয় যে, স্ত্রী এবং স্বামী একে অপরের পরিপূরক এবং তারা একে অপরকে ছাড়া অসম্পূর্ণ। সহধর্মিণী শব্দটি আরও বোঝায় যে, স্ত্রী তার স্বামীর সাথে সকল ধর্মীয়, সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেন।
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক :
ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং ধর্মে স্ত্রীকে স্বামীর ‘সহধর্মিণী’ হিসেবে সম্মান দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মে, স্ত্রীকে স্বামীর সহধর্মিণী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেখানে স্ত্রী শুধু স্বামীর সহধর্মিণী নন, বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার সঙ্গিনী।
সহধর্মিণী এবং ধর্ম :
হিন্দু ধর্মে, বিবাহিত জীবনকে একটি পবিত্র বন্ধন হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং স্ত্রীকে ‘সহধর্মিণী’ হিসেবে সম্মানিত করা হয়। এটি কেবলমাত্র একটি সাংস্কৃতিক ধারণা নয়, বরং একটি ধর্মীয় এবং আধ্যাত্মিক দিকও রয়েছে। স্ত্রী এবং স্বামীকে একসঙ্গে ধর্মীয় অনুষ্ঠান, পূজা এবং অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নিতে দেখা যায়। এটি তাদের পারস্পরিক সমর্থন এবং একতা প্রদর্শন করে।
সাহিত্যে সহধর্মিণী :
বাংলা সাহিত্যে ‘সহধর্মিণী’ শব্দটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কবি এবং লেখকগণ এই শব্দটির মাধ্যমে স্ত্রী-স্বামীর সম্পর্কের গভীরতা এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতা তুলে ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক তাদের রচনায় এই শব্দটির ব্যবহার করে সম্পর্কের গুরুত্ব এবং মর্যাদা তুলে ধরেছেন।
সামাজিক ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি :
আধুনিক সমাজে ‘সহধর্মিণী’ শব্দটি শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। আজকের যুগে নারীর মর্যাদা ও সমানাধিকারের গুরুত্ব বেড়েছে। স্ত্রীকে শুধুমাত্র ‘সহধর্মিণী’ হিসেবে নয়, বরং একজন স্বতন্ত্র ও সমান অধিকারসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তিনি পরিবারের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও সমানভাবে সাফল্য অর্জন করছেন।
সহধর্মিণী ও আধুনিক নারী :
আধুনিক নারীরা নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করতে এবং সমাজে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে সফল হয়েছে। তবুও, ‘সহধর্মিণী’ শব্দটির মূল ভাবনা থেকে সরে আসেনি। আজকের আধুনিক দম্পতিরা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে কাজ করছেন এবং পরস্পরের সফলতা ও সুখ-শান্তির জন্য একে অপরকে সমর্থন দিচ্ছেন।
সম্পর্কের মানসিক দিক :
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেবলমাত্র পারিবারিক নয়, মানসিক দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে অপরের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, সাফল্য-ব্যর্থতা সব কিছুতেই পরস্পরের পাশে থাকা, একে অপরকে সমর্থন দেওয়া এবং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একে অপরকে সহযোগিতা করা, এটাই ‘সহধর্মিণী’ শব্দের প্রকৃত অর্থ।
উপসংহার :
‘সহধর্মিণী’ শব্দটি কেবলমাত্র একটি সম্পর্কের সংজ্ঞা নয়, বরং এটি একটি ধারণা যা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গভীর সম্পর্ক এবং পারস্পরিক নির্ভরশীলতার প্রতীক। এটি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সাংস্কৃতিক, সামাজিক এবং মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক যুগে নারীর মর্যাদা ও স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি এই শব্দটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক সমানাধিকার ও সম্মানের প্রতিফলন ঘটায়।
‘সহধর্মিণী’ শব্দটি তাই শুধু একটি সম্পর্কের প্রতীক নয়, বরং এটি একটি মূল্যবোধ এবং আদর্শ যা যুগ যুগ ধরে সমাজে এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে আসছে।